ক্রিকেটে প্রযুক্তির অবদান, ক্রিকেটে ব্যবহৃত প্রযুক্তি সম্পর্কে খুঁটিনাটি আলোচনা



ক্রিকেটে প্রযুক্তির ব্যবহার দিনে দিনে যেভাবে বাড়ছে, তাতে এটি কেবল খেলোয়াড়দের খেলা নয়, প্রযুক্তিরও খেলা বটে! ক্রিকেটের জনপ্রিয় কিছু প্রযুক্তি নিয়ে এই প্রতিবেদন।ভিডিও বোলিং সিমুলেশন
খেয়াল করবেন, কদিন আগে ‘ভিডিও বোলিং সিমুলেশন’ নামে এক বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে ব্রিসবেনে বাংলাদেশ দলের নেট অনুশীলনে। ব্রিসবেনের অ্যালান বোর্ডার স্টেডিয়ামের পাশের মাঠে মাশরাফিদের সামনে সেদিন হাজির হয়েছেন মিচেল জনসন-জশ হ্যাজলউডের মতো গতিময় পেসাররা। তবে সেটা বাস্তবে নয়, পর্দায়!

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে আরও জানতে ভিজিট করুন প্রযুক্তি কর্নার

এই পদ্ধতিতে নেটের ব্যাটসম্যানের অপর প্রান্তে থাকে একটা বড় পর্দা। তাতে ভেসে ওঠে বল হাতে কোনো বোলারের ছবি, সেই বোলার দৌড়ে আসতে থাকেন ব্যাটসম্যানের দিকে, বল ছোড়েনও একটা পর্যায়ে। কিন্তু ব্যাটসম্যানের দিকে সত্যিকারের যে বলটা ধেয়ে যায়, সেটা আসলে আসে পর্দার পেছনে থাকা একটা বল করার যন্ত্র (বোলিং মেশিন) থেকে।
এ প্রযুক্তি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের কাছে নতুন হলেও ক্রিকেটে উন্নত দেশের জন্য বেশ পুরোনো। ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো আইসিসি এ প্রযুক্তিটি হস্তান্তর করে মার্কিন সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান-প্রোব্যাটার স্পোর্টস। একই বছরে দুবাইয়ে আইসিসি গ্লোবাল ক্রিকেট একাডেমিতে সরবরাহ করা হয় প্রোব্যাটার পিএক্স২ ক্রিকেট সিস্টেম।
স্পিড গান
বোলাররা বল করার পরই টিভি পর্দায় ভেসে ওঠে বলের গতি। বোলার ঘণ্টায় কত মাইল বা কিলোমিটার বেগে বল করলেন, সেটির ওপর বিশেষ নজর থাকে সবার। বলের এ গতি মাপা হয় ‘স্পিড গান’ প্রযুক্তির মাধ্যমে। পদ্ধতিটি ক্রিকেটে নিয়মিত ব্যবহার হচ্ছে ১৯৯৯ সাল থেকে।
যন্ত্রটি বসানো হয় সাইট স্ক্রিনের বেশ ওপরে। এটি গতি মাপে রাডার-বিমের সংকেতের সাহায্যে। বল পিচ করার পর পুরো লেংথ শনাক্ত করে এটি। আর পুরো পদ্ধতিটি সম্পন্ন হয় ক্ষুদ্রতরঙ্গ প্রযুক্তির মাধ্যমে। তবে বাতাসের গতি এখানে কোনো ভূমিকা রাখে না। ক্ষুদ্রতরঙ্গগুলো এতটাই শক্তিশালী, যেকোনো আবহাওয়ায় তা ভেদ করতে পারে। কেবল ক্রিকেটে নয়, এ প্রযুক্তি ব্যবহার হয় টেনিসেও।
স্পাইডার ক্যামেরা
২০১৪ সালের এপ্রিলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দর্শকেরা নিশ্চয় দেখেছেন, মাঠে উড়ে উড়ে খেলোয়াড়দের নানা মুহূর্ত ধারণ করছে একটি ক্যামেরা। খেলা চলার সময় খেলোয়াড়দের একদম হাতছোঁয়া দূরত্বে চলে যাচ্ছে সেটি!
স্পাইডারক্যাম প্রথম তৈরি হয় ২০০০ সালে, আর এর নেপথ্যের কারিগর অস্ট্রিয়ার প্রযুক্তিবিদ জেনস সি পিটার্স। এর সফল ব্যবহার হয় ২০০৩ সালে। এরপর ক্রমেই খেলাধুলায় বাড়তে থাকে এ প্রযুক্তির ব্যবহার। সাধারণ ক্যামেরার সঙ্গে এর মূল পার্থক্য—নির্ধারিত এলাকায় উল্লম্ব ও অনুভূমিকভাবে ইচ্ছেমতো নড়াচড়া করতে পারে ক্যামেরাটি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটে এর ব্যবহারে কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। কদিন আগে, ভারতের বিপক্ষে সিডনি টেস্টে একটি ক্যাচ হাতছাড়া করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ। পরে জানা যায়, স্পাইডার ক্যামেরায় লাগায় বলটি তালুবন্দী করতে ব্যর্থ হন স্মিথ!

বড় পর্দা
বড় পর্দা অন্য খেলাগুলোতে নিয়মিত ব্যবহৃত হলেও ক্রিকেটে এর তাৎপর্য ভিন্ন। ক্রিকেটে এর দুই রকম ব্যবহার। একদিকে ইলেকট্রনিক স্কোরবোর্ড হিসেবে। অন্যদিকে ঢাউস এলইডি পর্দায় ভেসে ওঠে ঝকঝকে ভিডিও, অ্যানিমেটেড ছবি, গ্রাফিকস ইত্যাদি।
এ ছাড়া ব্যাটসম্যানের শট খেলা ও আউট হওয়ার ধরন, বোলারের ডেলিভারি প্রভৃতির বিশ্লেষণ মুহূর্তেই মেলে পর্দায়। একজন বোলার বা ব্যাটসম্যানের দুর্বলতাগুলোও বাদ যায় না। দিনে দিনে আরও নানা বিষয় সংযোজিত হচ্ছে পর্দায়। খেলোয়াড় তো বটেই, দর্শকেরও দৃষ্টি থাকে বড় পর্দায়। এরই মধ্যে বিশ্বকাপ ফাইনালের ভেন্যু মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) বসানো হয়েছে নতুন প্রযুক্তির বড় পর্দা। ২৫ মিটার প্রস্থ ও ১৩ মিটার উচ্চতার এলইডি পর্দায় দর্শকেরা খেলার খুঁটিনাটি দেখতে পাবেন অনায়সে।

ডিআরএস—প্রযুক্তি যখন বিচারক
আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের বলি হওয়া ক্রিকেটে খুব পরিচিত দৃশ্য। খেলোয়াড়েরা এখন সহজেই আম্পায়ারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। চ্যালেঞ্জটা হয় ডিআরএস (ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম) পদ্ধতিতেই। যদিও এটি নিয়ে কম-বেশি বিতর্ক রয়েছে ক্রিকেট দুনিয়ায়। তবে পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় এর পক্ষে সমর্থন বেশি। ডিআরএসে ব্যবহৃত হয় তিনটি পদ্ধতি-হক-আই, হটস্পট ও স্নিকোমিটার।

হক-আই
বোলিং ডেলিভারিকে পাখির চোখে বিশ্লেষণ করা হয় এ পদ্ধতিতে। যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানী পল হকিন্সের আবিষ্কার করা এ পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করে চ্যানেল ফোর। আবিষ্কর্তার নামানুসারে ‘হক-আই’। প্রথম ব্যবহার ২০০১ সালের অ্যাসেজে।
বল পিচ করে স্টাম্পে নাকি বাইরে বা ওপর দিয়ে চলে যেত—এর পরিষ্কার বিশ্লেষণ মিলবে এ প্রযুক্তিতে। সাধারণত সংশয়মূলক এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্ত নিতে এ পদ্ধতির ব্যবহার। টেনিস তো বটেই, বর্তমানে ফুটবলের গোললাইন প্রযুক্তিতেও এর ব্যবহার রয়েছে।

স্নিকো-মিটার
স্নিকো-মিটারের কাজ শব্দ শনাক্ত করা। উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন মাইক্রোফোনের মাধ্যমে শনাক্ত হয় এ শব্দ। বল প্যাডে লাগল নাকি ব্যাটে, তা নির্ধারণ করা হয় শব্দের মাধ্যমে। এটি আবিষ্কার করেন ইংলিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান প্লাসকেট।

হটস্পট
অনেক সময় বল ব্যাটে লাগল নাকি প্যাড বা গ্লাভসে, তা নিয়ে ঢের বিতর্ক! এ বিতর্ক নিরসনে ব্যবহার করা হয় হটস্পট প্রযুক্তি। এটি মূলত ইনফ্রা-রেড রশ্মি দিয়ে ছবি তোলার ব্যবস্থা। দুটি শক্তিশালী থার্মাল-ইমেজিং ক্যামেরা থাকে মাঠের দুই প্রান্তে। বলের সঙ্গে যে কোনো বস্তুর (ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস বা খেলোয়াড়ের শরীর) ঘর্ষণের মুহূর্তে উৎপন্ন তাপ দূর থেকে দ্রুত পরিমাপ করতে পারে ক্যামেরা দুটি। এরপর বস্তুটির যে অংশে বলের ঘর্ষণ লাগে, কম্পিউটারে উৎপন্ন নেগেটিভ ছবিতে স্থানটি লাল দাগে চিহ্নিত হয়। তবে আইসিসি জানিয়েছে, এ বিশ্বকাপে হটস্পট প্রযুক্তির ব্যবহার থাকবে না।

No comments

Powered by Blogger.