গুগল ক্যামেরায় বনানী কবরস্থানে ‘ফাঁসিতে’ ঝুলন্ত মানব: আসল ঘটনা কী?

গুগল ম্যাপের স্ট্রিট ভিউ এ বনানী কবরস্থানের সামনের দেওয়ালের ওপরে ঝুলন্ত জিনিসটা দেখার পর থেকেই মাথাটা ঝিম ঝিম করছিল। মাথায় কেবলই ঘুড়ে বেড়াচ্ছিল, কী হতে পারে এটা!!! গুগল ম্যাপতো আর অন্য কেউ এডিট করতে পারেনা। তাহলে!?
অফিসের এক কলিগ বলছিলেন, ‘ভাই একটা লিংক পাইছি, দেখেন তো বিষয়টা কী? আমি তো কিছুই বুঝতেছিনা। ফেসবুকে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এ নিয়ে। ’
আমিও একটু কৌতুহলী হয়ে লিংকটা নিলাম এবং ব্রাউজ করে সত্যিই একটা ধাক্কা খেলাম। গুগল কারের ক্যামেরায় ধারণ করা স্ট্রিট ভিউ-এ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বনানী কবরস্থানের বাউন্ডারি ওয়ালের ওপরে  সাদা পাঞ্জাবী, কালো প্যান্ট এবং পায়ে কালো জুতো পড়া মানুষের অবয়বে কিছু একটা গাছের সাথে ঝুলানো আছে।
একটু স্পষ্ট করেই বলি, দেখে সত্যি মনে হচ্ছে কেউ যেন গলায় দড়ি দিয়েছে। ছবিটা জুম করে বিভিন্নভাবে দেখলাম। গলার দড়িটাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে! তবে খুব আশ্চর্যজনকভাবে রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে! 
এত বড় একটা ঘটনা ঘটলে যেমন মানুষের জটলা হওয়া উচিত, তেমন নয়। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া রাস্তার কৌতুহলী মানুষের দৃষ্টি দড়ি থেকে ঝুলতে থাকা ‘মানুষটির’ দিকে নয়, বরং গুগল কারের দিকেই- সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু কেন? মানুষ কি এতটাই নিস্পৃহ হয়ে গেল এমন ভয়াবহ ঘটনার বিষয়ে! এটাও কি সম্ভব?
চিন্তা আর বিশ্লেষণের ঝড় বয়ে গেল মাথায়। কয়েকটা প্রশ্ন আসল মাথায়, তাহলে ঘটনা কি এমন যে বস্তুটা ঝুলছে সেটা খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না বা এমন কোনো তুচ্ছ বিষয় যেটার দিকে তাকিয়ে দেখার কিছু নেই।  
এরই মধ্যে অফিসের সবার মাঝে এটি একটি ‘গুরুতর’ ইস্যু হয়ে উঠেছে। হাতের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে এসেও এক ঝলক দেখে মন্তব্য করে যাচ্ছে কলিগরা। কেউ আবার মন্তব্য করতে গিয়ে আমতা আমতা করছেন। মোট কথা, ইস্যুটা নিয়ে বেশ আলোচনা চলতে থাকলো। কেউ সহজ সমাধান দিচ্ছে, বলছে, ভাই এইটা ভূত, কেউ বলে ভাই ভূত আবার কী জিনিষ!
কেউ বলছে, যতো যাই বলেন, এটা ফটোশপ করা হইছে। গুগুল সবাইরে মামু বানাইতে এই প্লান করছে। পরে বলবো- গ্রাহকদের বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা করলাম। হে...হে... 
মোট কথা আলোচনা বেশ জমজমাট। কিন্তু রহস্য উন্মোচন হচ্ছে না... এটাই অস্বস্তিকর লাগছে।  
আমি ভাবছি অন্য কথা! এতবড় একটা বিষয় গুগলের চোখ এড়ালো কী করে? সাধারণত গুগল নিরাপত্তাজনিত কারণে স্ট্রিট ভিউতে থাকা মানুষের চেহারা, গাড়ির নম্বর, বাড়ির নম্বর এগুলোকে অষ্পষ্ট করে দেয়। সেই টেক জায়ান্ট গুগল রাস্তার পাশে ফাঁসিতে ঝুলে থাকা একজন মানুষের ৩৬০ ডিগ্রি ছবি রেখে দিয়েছে!!!
এবার ছবিটিকে বারবার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ঘুড়িয়ে দেখতে থাকি। দড়ি থেকে ঝুলছে এটা পরিষ্কার। সাদা পাঞ্জাবী, প্যান্ট আর বুট পায়ে- এসবও পরিষ্কার। তাহলে! এসময় একজন বললেন- ফাঁসিতে ঝুললে তো একটা মানুষের পায়ের নিচের অংশও নিম্নমুখী হয়ে থাকে অর্থাৎ পায়ের আঙুলের দিকটা নিচের দিকে থাকে। কিন্তু এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে জুতো পরা পা দুটি মনে হয় মাটিতে দাঁড়ানো অবস্থায় আছে।  
কথাটা ঠিক।
কিন্তু আবার সন্দেহ হলো- তাহলে কি কাঁচের ওপরে পা দুটো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে?
এসব ভাবছি আর ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখছি ৩৬০ ডিগ্রির ছবিটি। এসময় আরেকটি বিষয় নজরে এলো। ‘ফাঁসিতে ঝুলে থাকা’ লোকটার হাত দুটোও ঝুলে নেই, পাশে একটু যেন ছড়ানো- তবে এটা অস্পষ্ট।  
এবার, আবার শুরু থেকে শুরু করলাম ছবিটিকে এবং এমন একটি অ্যাঙ্গেলে মাউস আনলাম- যেখান থেকে বিষয়টি অন্যরকম মনে হলো- হ্যাঁ, এটা কোনো মানুষ না- এটা হচ্ছে একটা কুশপতুল বা কুশপত্তলিকা (effigy)। রাজনৈতিক আন্দোলনে বা যে কোনো বিক্ষোভ-সমাবেশে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাতে হলে তার একটা প্রতিকী পুতুল তৈরি করে তাতে জুতো, ঝাটা মারা হয়, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, এমনকি ওই পুতুলকে প্রতিকী ফাঁসিতেও ঝোলানো হয়।
এসময় চেক করে দেখলাম ছবিটি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের। জানা গেল, ওই সময়ে দেশজুড়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন, বিশেষ করে শাহবাগের আন্দোলন তুঙ্গে ছিল। এর পর ছিল হেফাজতের ঘটনা। যেটা ধারণা করা গেল, ওই সময়ে কোনো মিছিল বা বিক্ষোভে সম্ভবত এই কুশপুতুলটি ব্যবহার করা হয়। পরে কেউ এটাকে কবরস্থানের পাশের গাছে ঝুলিয়ে দেয়- হয়তো বা।  

No comments

Powered by Blogger.